মানব জীবন ও গ্রন্থাগার

        মানুষ কাকে বলে বা মানুষের সংজ্ঞা কী? মাথা, ধর, একজোড়া হাত-পা, চোখ-কান, ইত্যাদি শারীরিক কাঠামো বিশিষ্ট প্রাণিকেই কী মানুষ বলে? নাকি মানুষের সংজ্ঞা আরোও ব্যাপক? একটি পশু বা পাখিকে পশু-পাখি হওয়ার জন্য কোন চেষ্টা করতে হয় না, জ্ঞানার্জনের জন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়না বা প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো কিছু নতুনভাবে শিখতে হয়না।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- একটি বিড়াল ছানা (বা যেকোন প্রাণী) জন্মের পর থেকেই কীভাবে খেতে হবে, হাঁটতে হবে, বসতে হবে, ঘুমাতে হবে, চলতে হবে ইত্যাদি সবই জানে, কখনোই কোন ভুল করেনা বা নতুন করে তাকে আর কিছুই শিখতে হয়না। কিন্তু একজন মানুষকে মানুষ হতে হলে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়, অনেক কিছু শিখতে হয়, অনেক কিছু অর্জন করতে হয়। একটি কম্পিউটার যেমন কিছু হার্ডওয়্যার (মনিটর, সিপিইউ, কীবোর্ড, মাউস) ও সফটওয়্যার (অপারেটিং ও অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার) এর সমন্বয়ে গঠিত ঠিক একইভাবে মানুষও শরীর (হার্ডওয়্যার), আত্মা ও মন (সফটওয়্যার) এই তিনটির সমন্বয়ে সৃজিত একটি প্রাণী যাকে অনান্য সকল সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। একটি মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় শরীর (হার্ডওয়্যার) ও আত্মা (অপারেটিং সিস্টেম) এই দুইটি বস্তু নিয়ে পৃথিবীতে আসে। পৃথিবীতে আসার পর তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়, অনেক কিছু শিখতে হয়, অনেক কিছু জানতে হয় যেমন- কোনটা তার খাবার? কোনটা অখাদ্য? কোথা থেকে খাবার পাওয়া যায়? কীভাবে পাওয়া যায়? কীভাবে পোষাক পরতে হবে? কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে? কীভাবে হাঁটতে হবে? কীভাবে ঘুমাতে হবে? কোন্ কাজ করা যাবে? কোন্টা করা যাবেনা? ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবকিছুই আমরা শিশুকাল থেকেই শিখতে থাকি সারাটি জীবন ধরে, সচেতনভাবে অথবা অবচেতন মনে। আর মানুষের পার্থক্য এখানেই। তাকে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নামক একটি স্বতন্ত্র বস্তু দেয়া হয়েছে যা মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ পরিচয়ে পরিচিত করেছে। এজন্যই কবি শেখ হবিবর রহমান বলেছেন-

“বল হতে বুদ্ধি বড়         বুদ্ধি নাই বল আছে
কী তাহার পরিণাম         শিখিবে হাতির কাছে
অতিকায়, অতিবল         ঘটে বুদ্ধি মাত্র নাই
দুর্বল মানব তার         প্রভু হইয়াছে তাই”

        মানুষের বেড়ে ওঠার জন্য যেমন শারীরিক/দৈহিক বিকাশ সাধন প্রয়োজন অনুরূপভাবে আত্মিক ও মানসিক বিকাশও আবশ্যক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা বেশিরভাগ মানুষই শুধু শরীরের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারেই মনযোগী। আত্মিক ও মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য চেষ্টা করা তো দূরে থাক এর আবশ্যকতাও আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা। শারীরিক বিকাশ সাধনের জন্য যেমন নিয়মিত খাদ্যগ্রহণ করতে হয়, দৈহিক পরিচর্যা করতে হয়, যত্ন নিতে হয়, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করতে হয় একইভাবে আত্মিক ও মানসিক পরিপুষ্টি সাধনের জন্যও খাদ্যগ্রহণ করতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করতে হয়। 

        এখানে প্রশ্ন হতে পারে আত্মার বা মনের খাদ্যগ্রহণের মানে কী? আমার ধারণা- আত্মার খাদ্য হল ধর্মীয় উপাসনা যা প্রতিটি ধর্মই বলে থাকে। এজন্যই আমরা ধর্মীয় উপাসনালয়ে যাই বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করি। অন্যদিকে মনের খোরাক হল জ্ঞানার্জন, যেটা সকল মনীষীই বলে গিয়েছেন বা আমরা সাধরণ মানুষও যা উপলব্ধি করতে পারি যেমনটা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। 

        আমরা বুঝি আর নাই বা বুঝি, স্বীকার করি আর নাই করি একথা সত্য যে, শরীরের অসুস্থতা যেমন আমাদের পীড়া দেয়, আত্মার/মনের অসুখও একইভাবে আমাদেরকে নি:শেষ করে। পাঠক হয়তো আবার প্রশ্ন করবেন আত্মার/মনের অসুস্থতা আবার কী? আমি সংক্ষেপে শুধু এতটুকুই বলবো যে, আত্মার বা মনের অসুস্থতা তো আছেই বরং অনেকাংশে তা শরীরের অসুস্থতার থেকেও কম নয়। কারণ শরীরের অসুস্থতা আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু আত্মা/মনের অসুখের ব্যাপারে আমরা খেয়ালই রাখিনা। অথচ আমরা প্রত্যেকেই আত্মার/মনের অসুস্থতায় ভুগি। অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, ক্রোধ, পরশ্রীকাতরতা, পরচর্চা, শত্রুতা, হতাশা, চরমপন্থা ইত্যাদি সবই আত্মার/মনের রোগ যা পাঠক মাত্রই স্বীকার করবেন। যার একটিও যদি আমদের জীবনে থেকে থাকে তবে তা নিশ্চিতভাবে আমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে। 

        এসকল মহামারি (ক্যানসার) থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো জ্ঞানের চর্চা ও সে অনুযায়ী জীবনকে সাজিয়ে তোলা। জ্ঞানার্জনের দ্বারাই মানুষ তার ভেতরের মানুষটিকে জাগিয়ে তুলতে পারে, হতে পারে একজন বিবেকবান মানুষ। একজন মানুষ যখনই জ্ঞানী হতে থাকে তখনই সে নিজের ভেতরের সুকোমল বৃত্তিগুলোর পরিচর্যা করার প্রয়াস পায় এবং একইসাথে নিন্দনীয় দোষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়। এভাবেই জ্ঞানার্জন মানুষকে আলোকিত ও পবিত্র করে তোলে এবং তার আলোয় সমাজ আলোকিত হয়। 

        আর জ্ঞানচর্চা/জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বোত্তম স্থান হচ্ছে গ্রন্থাগার। কারণ সভ্যতার বাহন হলো গ্রন্থাগার। সুশিক্ষার প্রসার এবং প্রকৃত জ্ঞান ও মননশীলতা চর্চার জন্য গ্রন্থাগারের কোন বিকল্প নেই। “বই জ্ঞান ধারণ করে আর গ্রন্থাগার বই ধারণ করে। বই যদি হয় স্থির জলের পাত্র, তবে গ্রন্থাগার বহমান বিস্তৃত জলরাশি। বইতে জ্ঞানের বারিধারায় স্নাত হওয়া যায়, কিন্তু সাঁতার কাটতে হলে যেতে হয় গ্রন্থাগারে (আশীষ কুমার সরকার, ২০১৬)।” এজন্যই বোধ করি বিখ্যাত প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী লাইব্রেরিকে হাসপাতালের সাথে তুলনা করেছেন যেমন তিনি বলেছেন- এদেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয়, এবং স্কুল কলেজের চাইতে কিছু বেশি। দেহের সুস্থতার জন্য হাসপাতালের প্রয়োজন আর মনের সুস্থতার জন্য দরকার লাইব্রেরি।

        পাঠক নিশ্চয়ই এবার একথা বলবেন যে, জ্ঞানচর্চাই যদি মুখ্য উদ্দেশ্য হয় তবে সেটির জন্য তো অনেক মাধ্যম/উপায়/পদ্ধতি (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান/ ভ্রমণ/ পর্যবেক্ষণ/ অভিজ্ঞতা/ দৈনন্দিন-জীবনাচার/ টিভি দেখা/ ইন্টারনেট ব্রাউজিং ইত্যাদি) রয়েছে তাহলে বই-ই কেন পড়তে হবে কিংবা গ্রন্থাগারেরই বা কেন যেতে হবে? এর উত্তরে আমি বলবো জ্ঞানার্জনের জন্য যতগুলো উপায়/পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে বইপাঠ হল সহজতম এবং সর্বোত্তম উপায়। যেকথাটিই প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তার ‘বই-কেনা’ প্রবন্ধে বলে গিয়েছেন। মানুষের হাজার বছরের চিন্তা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিবরণী কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে থাকে বইয়ের পাতায়। বই পাঠের মাধ্যমে আমরা যুগ-যুগান্তরের মনীষীদের চিন্তার সাথে পরিচিত হতে পারি, ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে পারি এবং জীবনকে সে অনুপাতে গড়তে পারি। 

        অন্যদিকে আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্ঞানচর্চার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের আমরা কতটুকু উৎসাহিত করতে পারছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে যার কিছু পংক্তি আমি এখানে উদ্ধৃত করছি- আমাদের স্কুল কলেজের শিক্ষার পদ্ধতি ঠিক উলটো। সেখানে ছেলেদের বিদ্যে গেলানো হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক। এর ফলে ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। 

        তাছাড়া আমরা যারা বিদ্যালয়ে যাই কজনই বা জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে যাই বা ভাল মানুষ হওয়ার জন্য পড়ি? আমরা প্রায় সবাই বিদ্যালয়ে যাই ভাল (?) ফলাফল (A+) লাভের প্রত্যাশায় কখনোও বা যাই ভাল (?) চাকুরী পাওয়ার লোভে। অথচ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন-শিক্ষার উদ্দেশ্য মনুষ্যত্বের বিকাশ করা, চাকুরী বা শুধু জ্ঞানার্জন নয়। যে জ্ঞান আমাদেরকে সত্যিকারের মানুষ করে তোলে বা আমাদের মাঝে মনুষ্যত্বের জন্ম দেয়, সেই জ্ঞান কী আমরা বিদ্যালয়ে চর্চা করি, না করার সুযোগ/সময় পাই? এজন্যই আজকে আমরা নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বড়-বড় ডিগ্রী অর্জন করছি ঠিকই কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হতে বা আমাদের ভেতরের ঘুমন্ত মানুষটিকে জাগাতে পারছিনা। তাই আমার মনে হয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় রোধে এবং মানব জীবনকে সার্থক করতে গ্রন্থাগারই হতে পারে সর্বোৎকৃষ্ট বিকল্প।

পরিশেষে প্রমথ চৌধুরীর কথাটিই পুর্নব্যক্ত করছি- “লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়; তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচেছ একরকম মনের হাসপাতাল।”


সাজ্জাদুল করিম 
 বি.এ (সম্মান), এম.এ, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও
লাইব্রেরিয়ান, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার, শেরপুর।
sazzad.karim70@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলাদেশের উন্নয়নে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকা

সুনাগরিক তৈরি ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে গ্রন্থাগারের ভূমিকা

পাঠ, পাঠাভ্যাস ও পাঠক