লাইব্রেরি মানে বইয়ের দোকান : একটি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা
লাইব্রেরি শব্দটি আমাদের কাছে বহুল পরিচিত ও প্রচলিত একটি শব্দ। আমরা সবাই
এই শব্দটি ব্যবহার করি কিন্তু শব্দটির সঠিক অর্থ জানি না। সত্যি বলতে কী - লাইব্রেরি
বলতে কোন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুঝায় বা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ কী আমাদের অধিকাংশই তা
জানি না। যার ফলে আমরা শব্দটির অপপ্রয়োগ করি। যেমন আমাদের সমাজে লাইব্রেরি বলতে এমন
প্রতিষ্ঠানকে বুঝানো হয় যারা বই ও স্টেশনারি মালামাল কেনা-বেচা করে। আবার লাইব্রেরি
বলতে অনেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিসকক্ষও বুঝে থাকে। কেউ কেউ মনে করে কিছু বই একসাথে
জমা করে রাখলেই সেটি লাইব্রেরি। অনেকে আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে বই সংক্রান্ত যেকোন প্রতিষ্ঠানকেই
লাইব্রেরি হিসেবে জানে। আসলে এর কোনটিই সঠিক নয়, এগুলো নিছক একটি ভুল ধারণা।
লাইব্রেরি (Library) একটি ইংরেজী শব্দ বাংলায় যার আভিধানিক অর্থ হলো গ্রন্থাগার
বা পাঠাগার। আর পরিভাষায়- যে প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস তথা বই, অভিধান,
বিশ্বকোষ, সংবাদপত্র, সাময়িকী, প্রতিবেদন, ছবি, ম্যাপ, প্রামাণ্যচিত্র ইত্যাদি সংগ্রহ,
প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং সেবাগ্রহীতাদের জন্য পাঠ-সুবিধা, ধার,
গবেষণা, রেফারেন্স, Indexing, Abstracting সহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করে তাকেই লাইব্রেরি
বা গ্রন্থাগার বলে।
লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার প্রধানত চার প্রকারের হয়ে থাকে যেমন : ১. জাতীয় গ্রন্থাগার
(National Library) ২. গণগ্রন্থাগার (Public Library) ৩. শিক্ষায়তনিক গ্রন্থাগার
(Academic Library) ৪. বিশেষ গ্রন্থাগার (Special Library)। তাছাড়া ব্যক্তি ও পারিবারিক
উদ্যোগেও গ্রন্থাগার পরিচালিত হয়। আবার ধরণের বিবেচনায় উপরের প্রত্যেকটি লাইব্রেরিকেই
কয়েক ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন : ১. প্রথাগত
লাইব্রেরি (Traditional Library) ২. ই-লাইব্রেরি (E-Library) বা ডিজিটাল লাইব্রেরি
(Digital Library) ইত্যাদি।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন হবে, তাহলে লাইব্রেরি বলতে আমরা সাধারণত যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে
বুঝি সেগুলো আসলে কী? হ্যাঁ, সেগুলো মূলত গ্রন্থ বা বই বিপণি (Book Shop) অথবা স্টেশনারি
দোকান যারা বই, খাতা, কলম ও অন্যান্য স্টেশনারি মালামাল ক্রয়-বিক্রয় বা বিপণন করে।
মজার বিষয় হলো এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমারা Library বললেও পাঠাগার বা গ্রন্থাগার বলতে
কিন্তু ঘোর আপত্তি করি। যদিও Library শব্দের বাংলা পরিভাষা
হলো গ্রন্থাগার বা পাঠাগার।
লাইব্রেরি ও গ্রন্থ-বিপণির
মধ্যে সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন:
· লাইব্রেরির মূল উদ্দেশ্য হলো- জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় সহযোগিতা, তথ্য সরবরাহ,
পাঠাভ্যাস তৈরিতে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে সুস্থ বিনোদনে উৎসাহ প্রদান। অন্যদিকে গ্রন্থ-বিপণির
মূল উদ্দেশ্যই হলো বিপণন বা বাণিজ্য।
· লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য কিছু আইন-কানুন, বিধি-বিধান, নীতিমালা অনুসরণ করতে
হয় যেখানে গ্রন্থ-বিপণির ক্ষেত্রে এরকম কোন বিধিবদ্ধ নিয়ম-কানুন নেই।
· লাইব্রেরিতে যারা কাজ করেন তাদেরকে গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা (Library
Management) বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা/ডিগ্রী (পিএইচডি, এমফিল, এমএ, বিএ, পিজিডি
ইত্যাদি) অর্জন করতে হয়। অন্যদিকে গ্রন্থ বিপণিতে কাজ করতে এরকম বিশেষ কোন ডিগ্রীর
প্রয়োজন নেই।
· এক কথায়- গ্রন্থ বিপণি হলো বই ও অন্যান্য শিক্ষাপোকরণ বিপণন কেন্দ্র আর লাইব্রেরি
হলো বই ও বিভিন্ন পাঠোপকরণ সংরক্ষণাগার।
পাঠক এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবেন যে, এই বিষয়টিকে অযথাই এতো গুরত্ব প্রদানের কারণ কী? বইয়ের দোকান বা স্টেশনারি দোকানকে লাইব্রেরি বললে কী এমন ক্ষতি? এর উত্তরে আমি শুধু এতটুকুই বলব - বাঘ ও বিড়াল, লবণ ও চিনি, ঔষধ ও গরল ইত্যাদি যেমন দেখতে একই রকম মনে হলেও ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত অনুরূপভাবে বাহ্য দৃষ্টিতে বইয়ের দোকান ও লাইব্রেরি একই রকম মনে হলেও উভয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। যাদের মধ্যে তালগোল পাকানোর কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া ঔষধের দোকানকে (Medicine Shop) হাসপাতাল (Hospital) বলা যেমন বিভ্রান্তি ঠিক একইভাবে বইয়ের দোকানকে লাইব্রেরি বলাও নিছক ভ্রান্ত ধারণা। একজন ঔষধ বিক্রেতাকে ডাক্তার বলা যেমন হাস্যকর তেমনি বইয়ের দোকনিকে লাইব্রেরিয়ান সম্বোধনে আখ্যায়িত করাও নিতান্তই অজ্ঞতা। এরপরও যদি কেউ বইয়ের দোকানকে লাইব্রেরি বলতে চান তাদেরকে বলব - ভুল করা দোষের কথা নয় বরং ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা দূষণীয়।
লেখক : সাজ্জাদুল করিম, লাইব্রেরিয়ান, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার শেরপুর ; ই-মেইল: sazzad.karim70@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন