স্মার্ট বাংলাদেশ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও লাইব্রেরি

 জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সর্বদা সোনার মানুষের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন- যা তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা-ভাষণ ও লেখনি থেকে জানা যায়। যেমন তিঁনি বলতেন “সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষের দরকার। তাহলেই সোনার বাংলা গড়তে পারব।” সোনার মানুষ বলতে তিঁনি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত, নীতিবান, আদর্শ মানুষের কথা বলতেন যারা সকল অনিয়ম-দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে বাংলার দু:খী মানুষের জন্য কাজ করবে। আর এই সোনার মানুষ গড়তে প্রথমেই যেটি দরকার তা হলো ‘সুশিক্ষা’। যে শিক্ষা মানুষের মানবিক বোধকে জাগ্রত করে নিজেকে সকল প্রকার দুর্নীতি, অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বাঁচিয়ে বিবেকবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে তাই সুশিক্ষা। একমাত্র সুশিক্ষিত মানুষই পারে একটি সুন্দর সমাজ, সভ্য জাতি ও উন্নত দেশ উপহার দিতে। আর সুশিক্ষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিখ্যাত প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন- “আমার বিশ্বাস, শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত।”

 

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনার বাংলার; আর তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখছেন স্মার্ট বাংলাদেশের। স্মার্ট বাংলাদেশের এই ধারণাটি মূলত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত একটি স্বপ্ন যা, ২০৪১ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বাস্তবে রুপ দেয়া হবে। Digital Bangladesh ধারণাটি একসময় যেমন কাল্পনিক মনে হলেও তা আজ বাস্তব সত্য একইভাবে Smart Bangladesh ধারণাটিও ২০৪১ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে যা সময়োপযোগী, বাস্তবসম্মত এবং যৌক্তিক পরিকল্পনা। বাস্তবিক অর্থে Digital Bangladesh ধারণাটির পরবর্তী ধাপই হলো ‍Smart Bangladesh যা হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং উদ্ভাবনী। Smart Bagladesh বলতে মূলত এমন বাংলাদেশকে বুঝায় যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদন এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা আরো সহজে জনগণের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়া যাবে। বিশেষ করে ৪র্থ শিল্প-বিপ্লবের চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে আধুনিক প্রযুক্তির (AI, IOT, VR, Robotics, Nano Technology, 3D printing ইত্যাদি) সর্বাধিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে সহজ করাই Smart Bangladesh ধারণার মূল কথা। এই ধারণাটি প্রধানত: চারটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো:

·      Smart Citizens (স্মার্ট নাগরিক)

·      Smart Government (স্মার্ট সরকার)

·      Smart Economy (স্মার্ট অর্থনীতি)

·      Smart Society (স্মার্ট সমাজ)

২.

এখন কথা হলো- ‘স্মার্ট’ বলতে আসলে কী বুঝায়? যদিও এই শব্দটিকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন তথাপি আমার কাছে মনে হয় ‘স্মার্ট’ শব্দটির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তথ্য-প্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা, উদ্ভাবন এই শব্দগুলোর একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। সত্যি বলতে কি এই শব্দগুলো ছাড়া ‘স্মার্ট’ শব্দটিই অস্তিত্বহীন। এজন্য স্মার্ট বাংলাদেশ আসলে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী জাতি গঠনেরই রূপকল্প। এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়েই সরকার এরই মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ রূপকল্প বাস্তবায়নে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহযোগিতায় একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে। এটি প্রণীত হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের তিনটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনকে সামনে রেখে। এগুলো হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা, উদ্ভাবনী জাতি গঠন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ বিনির্মাণ। আর জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির চারটি উপাদানশিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবন, তথ্য-প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের ব্যবস্থাপনা ও সৃজনশীলতাকে সামনে রেখে এই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হচ্ছে।

 

এখন লাইব্রেরি কীভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করবে বা Smart Bangladesh ধারণার সাথে লাইব্রেরির প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু চলুন সে সম্পর্কে একটু আলাপ করি। প্রথমত: আমরা বলেছি স্মার্ট বাংলাদেশ হবে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি দেশ যেখানে নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরো সহজ করবে এবং আমরা ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে পারবো। এখন আমাদের বুঝতে হবে প্রযুক্তি আসলে কী? সত্যিকারার্থে প্রযুক্তি নিজেই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার ফসল। প্রতিটি প্রযুক্তির পেছনেই রয়েছে গবেষণার দীর্ঘ ইতিহাস এবং প্রতিটি প্রযুক্তিই প্রতিনিয়ত গবেষণার মধ্য দিয়ে আপডেট হচ্ছে। কাজেই আমরা বলতে পারি- Technology is a knowledge and research oriented product itself. আর এখানেই লাইব্রেরির সাথে প্রযুক্তির প্রাসঙ্গিকতা। অর্থাৎ লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র আর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার ফসল হলো প্রযুক্তি। 

দ্বিতীয়ত: আমরা জানি প্রযুক্তির দুনিয়া প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রতিদিনই নিত্য-নতুন সব ফিচার নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। এজন্য এই বাজারে টিকে থাকতে হলে creativity, innovation, critical thinking ইত্যাদি দক্ষতার কোন বিকল্প নেই। আর বই পড়ার মাধ্যমেই এসকল দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। অর্থাৎ বই পাঠের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মাঝে সৃজনশীলতা, কল্পনা শক্তি, চিন্তাশীলতা, উদ্ভাবন দক্ষতা, দুরদৃষ্টি এসব দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।  Microsoft এর প্রতিষ্ঠাতা Bill Gates, Apple এর CEO Steave Jobs যার জীবন্ত উদাহরণ। যাদের বইপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। 

তৃতীয়ত: আমরা জানি সবকিছুরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। একইভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে গেলেও বেশ কিছু নেতিবাচক বিষয় বিশেষ করে প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার আমাদেরকে সমস্যায় ফেলবে। যেমন বর্তমানেও একদিকে আমরা Digital Bangladesh এর অনেক সুবিধা যেমন ভোগ করছি অন্যদিকে এর নেতিবাচক ব্যবহারের কারণে নতুন নতুন সসমস্যাও আমাদেরকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ cyber bulling, account hacking, child pornography, harassment, drug trafficking, intellectual property theft এরকম নিত্য-নতুন অপরাধ আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই আগমী প্রজন্মকে সকল ব্যবস্থার ইতিবাচক ব্যবহারে আগ্রহী করতে তাদের মাঝে নৈতিক ও মানবিক উৎকর্ষ সাধনের বিষয়টিকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। আর এক্ষেত্রে লাইব্রেরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতা আয়োজন, অনুপ্রেরণামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন, Library orientation, campaigning ইত্যাদির মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ ও অভ্যাস তৈরি করা যেতে পারে। যা তাদের মূল্যবোধ বিকাশে সহায়তা করবে। 

চতুর্থত: ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ার যে প্রত্যয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যক্ত করেছেন তার প্রকৃত বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব যখন আমরা নাগরিকরা সর্বপ্রথম স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবো। কারণ আমরা নাগরিকরা যদি unsmart থাকি তবে শুধু অবকাঠামো বা system smart করে সত্যিকার ফল পাওয়া যাবেনা। আর স্মার্ট হতে হবে প্রথমত চিন্তা-চেতনায়, মননে, দর্শনে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, বিশ্বাসে। এজন্য প্রথম ও প্রধান উপাদানই হলো knowledge তথা জ্ঞান। কারণ জ্ঞানই প্রকৃত অর্থে smart ও unsmart এর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। জ্ঞান ছাড়া কোনো দিক থেকেই স্মার্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ স্মার্ট বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্র যেমন- কৃষি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি সবই হবে জ্ঞান-নির্ভর। কাজেই স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক হতে হলে সর্বাগ্রে আমাদেরকে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে। 

পঞ্চমত: সর্বোপরি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের লাইব্রেরিগুলোকেও smart করতে হবে। আর লাইব্রেরির স্মার্ট হওয়া মানে- 

  • লাইব্রেরির সংগ্রহগুলো স্মার্ট হতে হবে। যেমন: কাগজে মুদ্রিত পাঠসামগ্রীর সাথে লাইব্রেরিতে digital content, e-material, online content, Audio book, Animation, Video content ইত্যাদিও রাখতে হবে। 
  • লাইব্রেরির কার্যক্রম ও সেবা স্মার্ট করতে হবে। যেমন: লাইব্রেরির Website, Apps তৈরি করা, 24/7 প্রবেশ সুবিধা নিশ্চিত করা, Mobile library সুবিধা সম্প্রসারণ, লাইব্রেরির নৈমিত্তিক কার্যক্রমে AI, IOT, Robotics, Nano Technology, 3D printing ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করা ইত্যাদি। 
  • লাইব্রেরির কর্মীদেরকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ ও সক্ষম হতে হবে। এজন্য প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির মাধ্যমে লাইব্রেরি কর্মীদেরকে প্রশিক্ষিত করা। 

পরিশেষে বলবো, পৃথিবীর স্মার্ট দেশ ও জাতিগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই একটা বিষয় পরিস্কার হয় যে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা এবং প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করেই এই অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। কাজেই এই বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে বিশেষ করে লাইব্রেরি তথা জ্ঞান-নির্ভর এই প্রতিষ্ঠানটিকে পেছনে রেখে কারোও পক্ষে স্মার্ট হওয়া কল্পনাতীত। তাইতো আমরা দেখি যে দেশগুলো যত উন্নত তাদের লাইব্রেরিগুলোও তত সমৃদ্ধ ও আধুনিক। প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে তারা লাইব্রেরিকে অপাংক্তেয় মনে করেনি বা এর উপযোগিতাও ফুরিয়ে যেতে দেয় নি; বরং প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করে প্রতিনিয়ত তাদের লাইব্রেরিগুলোকে উন্নত করছে। আর তাই তো করার কথা। কারণ জ্ঞান ছাড়া মানুষ বা মানব সভ্যতার কথা কি কল্পনাও করা যায়?

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

* প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও জেলা লাইব্রেরিয়ান, শেরপুর। ই-মেইল: sazzad.karim70@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলাদেশের উন্নয়নে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকা

সুনাগরিক তৈরি ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে গ্রন্থাগারের ভূমিকা

পাঠ, পাঠাভ্যাস ও পাঠক